অঁতনা আতো’র কবিতা : মলয় রায়চৌধুরীর অনুবাদ

অঁতনা আর্তোর কবিতা : মলয় রায়চৌধুরীর অনুবাদ

নিরংশু কবি

নিরংশু কবি, একটি তরুণীর বুক

তোমাকে হানা দিয়ে বেড়ায়,

তিক্ত কবি, জীবন ফেনিয়ে ওঠে

আর জীবন পুড়তে থাকে,

আর আকাশ নিজেকে বৃষ্টিতে শুষে নেয়,

জীবনের হৃদয়ে নখের আঁচড় কাটে তোমার কলম ।

অরণ্য, বনানী, তোমার চোখ দিয়ে প্রাণবন্ত

অজস্র ছেঁড়া পালকের ওপরে ;

ঝড় দিয়ে বাঁধা চুলে কবি চাপেন ঘোড়ায়, কুকুরের ওপরে ।

চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, জিভ নড়তে থাকে

আমাদের সংবেদনে স্বর্গ উথালপাথাল ঘটায়

মায়ের নীল দুধের মতন ;

নারীরা, ভিনিগারের কর্কশ হৃদয়,

তোমাদের মুখগহ্বর থেকে আমি ঝুলে থাকি ।

আমার টাকাকড়ি নেই

আমার টাকাকড়ি নেই কিন্তু

আমি আঁতোনা আতো

আর আমি ধনী হতে পারি

ব্যাপকভাবে আর এক্ষুনি ধনী হতে পারি

যদি আমি তার জন্য প্রয়াস করতুম ।

সমস্যা হলো আমি চিরকাল টাকাকড়িকে,

ধনদৌলতকে, বৈভবকে ঘৃণা করেছি ।

কালো বাগান

এই কালো পাপড়িগুলো ভারতের আকাশের  ঘুর্ণাবর্তকে ঘোরাও।

ছায়ারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে যা আমাদের সহ্য করে ।

তোমার নক্ষত্রদের মাঝে চাষের জমিতে পথ খুলে দাও ।

আমাদের আলোকিত করো, নিয়ে চলো তোমার নিমন্ত্রণকর্তার কাছে,

চাঁদির সৈন্যবাহিনী, নশ্বর গতিপথে

আমরা রাতের কেন্দ্রের দিকে যেতে চেষ্টা করি ।

আমি কে

আমি কে ?

আমি কোথা থেকে এসেছি ?

আমি আঁতোনা আতো

আর আমি একথা বলছি

কেননা আমি জানি তা কেমন করে বলতে হয়

তাৎক্ষণিকভাবে

তুমি আমার বর্তমান শরীরকে দেখবে

ফেটে গিয়ে বহু টুকরো হয়ে গেছে

আর তাকে আবার গড়ে ফেলবে

দশ হাজার কুখ্যাত পরিপ্রেক্ষিতে

এক নতুন শরীর

তখন তুমি আমাকে

কখনও ভুলতে পারবে না ।

স্নায়ু ছন্দ

একজন অভিনেতাকে দেখা হয় যেন স্ফটিকের ভেতর দিয়ে ।

মঞ্চের ওপরে অনুপ্রেরণা ।

সাহিত্যকে বেশি প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয় ।

আমি আত্মার ঘড়ি ধরে কাজ করা ছাড়া আর কোনো চেষ্টা করিনি,

আমি কেবল নিষ্ফল সমন্বয়ের যন্ত্রণাকে লিপ্যন্তর করেছি ।

আমি একজন সম্পূর্ণ রসাতল ।

যারা ভেবেছিল আমি সমগ্র যন্ত্রণার যোগ্য, এক সুন্দর যন্ত্রণা,

এক ঘন আর মাংসল পীড়া, এমন এক পীড়া যা বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ,

বুদবুদ-ভরা একটি নিষ্পেশিত ক্ষমতা

ঝুলিয়ে রাখা বিন্দু নয় — আর তবু অস্হির, উপড়ে-তোলা স্পন্দনের সাহায্যে

যা আমার ক্ষমতা আর রসাতলের দ্বন্দ্ব থেকে আসে

শেষতমের উৎসার দেয় ( ক্ষমতার তেজের দ্বন্দ্বের মাপ বেশি ),

আর কোনও কিছু বাকি থাকে না বিশাল রসাতলগুলো ছাড়া,

স্হবিরতা, শীতলতা–

সংক্ষেপে, যারা আমাকে অত্যধিক জীবনের অধিকারী মনে করেছিল

আত্মপতনের আগে আমার সম্পর্কে ভেবেছিল,

যারা মনে করেছিল আমি যন্ত্রণাদায়ক আওয়াজের হাতে নির্যাতিত,

আমি এক হিংস্র অন্ধকারে লড়াই করেছি

তারা সবাই মানুষের ছায়ায় হারিয়ে গেছে ।

ঘুমের ঘোরে, আমার পুরো পায়ে স্নায়ুগুলো প্রসারিত হয়েছে ।

ঘুম এসেছে বিশ্বাসের বদল থেকে, চাপ কমেছে,

অসম্ভাব্যতা আমার পায়ের আঙুলে জুতো-পরা পা ফেলেছে ।

মনে রাখা দরকার যে সমগ্র বুদ্ধিমত্তা কেবল এক বিশাল অনিশ্চিত ঘটনা,

আর যে কেউ তা খুইয়ে ফেলতে পারে, পাগল বা মৃতের মতন নয়,

বরং জীবিত মানুষের মতন, যে বেঁচে আছে

আর যে অনুভব করে জীবনের আকর্ষণ আর তার অনুপ্রেরণা

তার ওপর কাজ করে চলেছে ।

বুদ্ধিমত্তার সুড়সুড়ি আর এই  প্রতিযোগী পক্ষের আকস্মিক প্রতিবর্তন ।

বুদ্ধিমত্তার মাঝপথে শব্দেরা ।

চিন্তার প্রতিবর্তন প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা একজনের চিন্তাকে হঠাৎ নোংরামিতে পালটে দ্যায় ।

এই সংলাপটি চিন্তার অন্তর্গত ।

ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া, সবকিছু ভেঙে ফেলা ।

আর হঠাৎ আগ্নেয়গিরিতে এই পাতলা জলের স্রোত, মনের সরু, আস্তে-আস্তে পতন ।

আরেকবার নিজেকে ভয়ঙ্কর অভিঘাতের মুখোমুখি আবিষ্কার করা, 

অবাস্তবের দ্বারা নিরসিত, নিজের একটা কোনে, বাস্তব জগতের কয়েকটা টুকরো-টাকরা ।

আমিই একমাত্র মানুষ যে এর পরিমাপ করতে পারি ।

ভালোবাসা

আর ভালোবাসা? আমাদের নিজেকে পরিষ্কার করে ফেলতে  হবে

এই বংশগত নোংরামি থেকে

যেখানে আমাদের ভেতর নাক্ষত্রিক পোকা

কিলবিল করে বেড়ায়

.

সেই অঙ্গ, যে অঙ্গ বাতাসকে পিষে মারে

উত্তাল সমুদ্রের জোয়ারকেও

সেগুলো আসলে এই বিরক্তিকর 

স্বপ্নের ফালতু সুর

.

ওই মহিলার , আমাদের বা এই আত্মার

আমাদের সাথে ভোজসভায় বসেছে

আমাদের বলুন কে প্রতারিত হয়েছে,

কুখ্যাতির এই প্রেরণাদায়িনী

.

যে মহিলা আমার বিছানায় ঘুমায়

আর আমার ঘরের বাতাসে  ভাগ বসায়,

আমার মনের কড়িকাঠে বসে

টেবিলে পাশা খেলতে পারে

কালো কবি       

কালো কবি, একটি কুমারীর স্তন

তোমাকে তাড়া করে,

বিষণ্ণ কবি, জীবন ছটফট করে

আর শহরগুলো পুড়ে খাক হয়ে যায়,

আর  আকাশ  চুষে নেয় বৃষ্টিকে,

ঠিক যেমন তোমার কলম  জীবনের হৃদয়ে লেখালিখি করে ।

.

বনাঞ্চল, বনাঞ্চল, তোমার চোখে জীবিত,

একাধিক ডানার ওপর;

ঝড়ে ওড়ানো চুল নিয়ে,

কবিরা ঘোড়ায় চড়ে, কুকুরের ওপর চড়ে।

.
চোখ জ্বলে ওঠে, জিভ ছোবল মারে,

আকাশ আমাদের ইন্দ্রিয়ে ঢুকে ঢেউ তোলে

মায়ের পুষ্টিকর দুধের মতো;

নারীর দল, আমি তোমাদের মুখ থেকে ঝুলে আছি

.

আর তোমাদের কঠিন অম্লজারিত হৃদয়কে লাথাচ্ছি ।

রহস্যময় জাহাজ

আমার অসুস্হ স্বপ্নগুলোকে ভিজিয়ে দেয় এমন সমুদ্রে,

সেই প্রাচীন জাহাজ গিয়েছে হারিয়ে

কুয়াশায় লুকিয়ে আছে তার উঁচু মাস্তুল

বাইবেলের আর বৃন্দগানে-ভরা আকাশে।

.

তা কিন্তু গ্রিক যাজকদের মতন হবে না

যারা পাতাহীন গাছের মাঝে হালকা চালে খেলা করে;

 বিদেশে তার বিরল পণ্যসম্ভার

কখনই বিক্রি করবে না পবিত্র জাহাজ

.

জাহাজটা তো পৃথিবীর কোন উষ্ণ বন্দরের কথা জানে না,

চিরকাল একা, ও কেবল একমাত্র ঈশ্বরকে জানে,

যেমন-যেমন জাহাজটা  মহিমান্বিত, অসীম তরঙ্গে ঢেউ তুলে এগিয়ে যায় ।

.

রহস্যের মধ্যে ডুবে যায় তার ছুঁচালো মুখ;

রাতে, এর মাস্তুলের বাতিগুলো জ্বলজ্বল করে

মেরু নক্ষত্রের রহস্যময় রূপালী  নিয়ে।

প্রার্থনা

আহ, আমাদের দাও জ্বলন্ত করোটিগুলো

আকাশ থেকে বাজ পড়ে যে করোটিগুলো পুড়ছে

পরিষ্কার করোটি, আসল করোটি,

যেগুলো আপনার উপস্থিতির দ্বারা শুদ্ধ

.

আমাদের গভীর আকাশের গর্ভে পৌঁছে দাও

যেখানে ঝরনার জলে ভরে যায় খাদ 

আর  যেখানে ঘুর্নিজল তোমার ভাস্বর শক্তি দিয়ে 

আমাদের পূর্ণ করে তোলে

.

আমাদের খেতে দাও – এই দিনটিতে প্রতিদিনের 

বিভ্রান্তির পবিত্রতা খাওয়াও আমাদের,

আহ, তোমার রক্তের বদলে

আমাদের সাথে নক্ষত্র আর আগ্নেয়গিরির লাভা ভাগাভাগি করো,

.

আমাদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করো।  উপজাতিতে বিভক্ত করো

তোমার হাতের অনন্ত আগুন দিয়ে

 আমাদের  জ্বলন্ত রাস্তা দিয়ে পাঠাও,

যেখানে আমরা মৃত্যুর ওপারে গিয়ে মরতে পারবো

.

আমাদের মগজকে মুচড়ে বিকৃত করে দাও

আর যেমন-যেমন আমরা নতুন ঝড়ের মুখোমুখি হবো

আমাদের দেবত্বের পরিচয় জেনে নিয়ে,

আমাদের বুদ্ধিমত্তায় আনন্দ করো ।

.

যৌনতার পাড়া

যৌ্নতার পাড়া হঠাৎ  জীবন্ত হয়ে ওঠে

অবাঞ্ছিত মুখ দেখা দেয়;

ক্যাফেগুলো চোর-বাটপাড়ের, গুজগুজ-ফিসফিসে ভরা

রাস্তার দুধার।

.

যৌনসঙ্গ-লোভী হাত পকেট হাতড়ায় ,

পেটের তলায় কুঁচকি  তপ্ত হয়ে ওঠে;

আর যখন ইচ্ছার সংঘর্ষ হয়,

গর্তের তুলনায় মাথার দাম কমে যায় ।

.

আমার সাথে কুকুরদেবতা আর তার জিভ’

(The Umbilicus of Limbo থেকে)

আমার সাথে আছে কুকুরদেবতা আর  তার জিভ,

যা গলায় ফাঁস দিয়ে কেটে বসে যেতে পারে 

চুলকানিময় বিশ্বজগতের 

দুটো খিলানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা চামড়ার টুপিঅলাকে ।

.

আর এখানে রয়েছে জলের ত্রিভুজ

যা পোকার আদলে কুঁকড়ে-কুঁকড়ে চলে,

কিন্তু যা একটা জ্বলন্ত কুঁড়িকে

ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুরি মারতে তৈরি।

.

জঘন্য এই বিশ্বজগতের  বুকের তলায়

লুকিয়ে রেখেছে দেবী-কুক্কুরী

পৃথিবীর স্তন এবং হিমায়িত দুধ

যে তার ফাঁপা জিভকে  পচিয়ে দেবে ।

.

আর  এখানে রয়েছে হাতুড়ি-হাতে একজন কুমারী,

পৃথিবীর গুহাগুলোকে চুরমার করার জন্য তৈরি

সেখানে কুকুর নক্ষত্রের মাথার করোটি

ভয়ঙ্করভাবে উঠতে শুরু করে।

.

About Hungryalist Archive

Keep reading and get enlightened
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান